নেলি গণহত্যাঃ সংখ্যালঘু হত্যার নিকৃষ্ট উদাহারণ

RogKata

খুব ছোটবেলাকার কথা। হঠাৎ শুনতে পেলাম শিবির নামক এক জুজু নাকি রগ কেটে নিচ্ছে সবার!! শুনে তো গায়ের রক্ত হিম হবার যোগাড়! দিন গড়ালো, আমরা আরেকটু বড় হলাম। আমাদের চিন্তার জগতে তখনো শিবিরকে মানুষ বলে মনে হয়নি। মনে হতো, শিবির বোধহয় বাঘ ভাল্লুকের মতই কোন প্রাণী যারা সামনে কাউকে পেলে ঘাড় না মটকে বরং রগ কেটে নেয়।

গল্পটা শুধু আমার নাহ! মোটামুটি ৯০ দশকের পরে জন্ম নেয়া প্রতিটি মানুষেরই একসময় শিবির সম্পর্কে এমন ধারনাই ছিলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমাদের ছোট্ট মস্তিষ্কে এই ধারনাটা কে গেথে দিলো? কেনইবা আমরা চোখে না দেখা স্বত্তেও বিশ্বাস করতাম শিবির খুবই ভয়ানক কোন জন্তু? চলুন সেটা নিয়ে আজকের আলোচনা আগাই।

শিবির ঠিক কতটা নৃশংস এটা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে বেশ অনেকখানি অতীতে। ঘটনার সূত্রপাত ১৯৮২ সালের ১১ই মার্চ। এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির আয়োজিত নবাগত সংবর্ধনায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রীসহ বেশকিছু বাম সংগঠন। ঝরে যায় শিবিরের নিরীহ ৪ টি প্রাণ।
এখান থেকেই মূলত শিবিরের শহীদি হালখাতার সূত্রপাত। কিন্তু এখান থেকে শিবিরের নৃশংসতার প্রমান পেলেন না তাইতো? তবে চলুন কাহীনির আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক।

শিবিরের এই মেধাবী চার প্রাণ ঝরে যাবার পর সাধারণ ছাত্রদের মনে শিবিরের প্রতি ভালোবাসা জন্মাতে থাকে আর ঘৃনা জন্মাতে থাকে সেসব তথাকথিত প্রগতিশীল সংগঠনের প্রতি। তাই, তারা চিন্তা করতে থাকে কীভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে শিবির নিয়ে এক অজানা আতঙ্ক তৈরি করা যায়। ব্যাস, এখান থেকেই মূলত শিবিরকে ডি হিউম্যানাইজ করার সূত্রপাত।

একদিকে তারা শিবিরের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে অন্যদিকে টিভি চ্যানেল, পত্রিকা,রেডিওসহ যাবতীয় টুল ব্যবহার করে শিবিরের প্রতি জনমানসে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে থাকে। যেসময়ের কথা বলছি, তখনো ফেসবুক ইউটিউব আসেনি। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ততটা উন্নত নাহ। তাই মানুষ সহজেই পত্রিকার কথা বিশ্বাস করতে থাকে। যেকোনো হত্যাকান্ড বা নৈরাজ্যের সাথে পত্রিকাগুলো কোনরকম প্রমান ছাড়াই শিবিরের নাম জুড়ে দিতো। পরবর্তীতে শিবিরের লোকজন নির্দোষ প্রমানিত হলেও মানুষের মনে গেঁথে থাকতো সেই পত্রিকার নিউজ। ফলত, শিবিরকে ধীরে ধীরে দৈত্যদানবরুপে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

কয়েকটি উদাহারণ দিলেই বিষয়টা সহজ হয়ে যাবে আপনাদের কাছে।

শিক্ষার্থীদের কাছে শিবিরের মেসগুলিকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো শিবিরের আস্তানা শব্দ ব্যবহার করে। আস্তানা শুনলেই আমাদের হৃদয়ে এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে।
একইভাবে অন্য সবার হতো দলীয় প্রোগ্রাম , শিবিরের বেলায় “গোপন বৈঠক!”

সবার হতো আন্দোলন , শিবিরের বেলায় বলা হতো তাণ্ডব!

অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের বেলায় ছাত্রনেতা শব্দ ব্যবহার করলেও শিবিরের বেলায় মিডিয়া ব্যবহার করতো শিবিরের ক্যাডার”

অন্য সবার বইকে সাহিত্য বললেও, শিবিরের বইকে বলা হতো জিহাদি বই!

এভাবেই এক বয়ান দাড় করানো হয় শিবিরকে মানুষ থেকে দৈত্যদানবে পরিনত করার লক্ষ্যে।

বারবার এভাবে শিবিরকে মিডিয়া ট্রায়ালের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারনে মানুষ ধীরে ধীরে বিশ্বাস করে নেয় শিবির স্বাভাবিক কিছু নয়। তাই আমরা দেখতে পাই, শিবিরের কেউ মারা গেলে মানুষের মনে আর দাগ কাটেনি। শিবিরের বেলায় মানুষের মনোভাব অনেকটা এমন ছিলো যে, ” আহা, ছেলেটা ভালো, শুধু দোষের মধ্যে শিবির করে” এই বহুদিনের এমন চর্চার ফলেই আমরা দেখতে পাই, আবরার ফাহাদ, বিশ্বজিৎসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলিতে যখন শিবির সন্দেহে কাউকে মেরে ফেলা হয়েছে, মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন প্রতিবাদ করেনি যতক্ষণ না প্রমানিত হয়েছে তারা শিবির নয়। মানে দাড়ালো শিবির করলেই যেন কাউকে মেরে ফেলা জায়েজ।

এই সুযোগটাই কাজে লাগায় স্বৈরাচারী আওয়ামী শাসনযন্ত্র। তারা জানতো তাদের ফ্যাসিবাদ কায়েমের সবচেয়ে বড় বাঁধা শিবির এবং জামায়াতে ইসলামী। তাই জামায়াতকে প্রথমত নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে বাঘা বাঘা নেতাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। বাকী রইলো শিবির, তাদেরকেও নিয়মিত গুম, খুনের রুটিনে ফেলে পুরো নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রয়াস চালায়!!
কিন্তু কে জানতো এই শিবিরের হাতেই তাদের পতন হবে? জুলাই বিপ্লবে শিবির দেখিয়ে দেয় তারাও মানুষ, যে ভয় শেখ হাসিনা পেয়েছিলো সেটাই বাস্তব করে ফেলে শিবির। জনতাকে সাথে নিয়ে গুড়িয়ে দেয় স্বৈরাচারের মসনদ!! ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে শিখছে শিবির আসলে অতিপ্রাকৃত কিছু নয়, বরং একঝাঁক দেশপ্রেমিক মানুষের সমষ্টিই হচ্ছে শিবির।



কিন্তু প্রশ্ন যেটা থেকেই যায় সেটা হলো: শিবির কি তাহলে ধোয়া তুলসীপাতা।

উত্তর হচ্ছে নাহ। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিবিরের হাতেও অন্যদের রক্ত ঝরেছে। শিবিরের ওপর আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে দুএকজনকে পঙ্গু করে দিয়েছে শিবির। অবশ্য এখন পর্যন্ত কোন খুনের প্রমান নেই শিবির এর বিরুদ্ধে। কিন্তু শিবিরের এই লাঠির আঘাতকে মিডিয়া দেখিয়েছে ” রগ কাটা” হিসেবে। সাম্প্রতিককালেও এমন ঘটনা দেখেছি আমরা সিলেট এমসি কলেজে। সেখানে কথা-কাটাকাটি জেড়ে একজনকে পায়ে রড দিয়ে আঘাত করলে সেটাকে মিডিয়া শিবির রগ কেটে দিয়েছে বলে প্রচার করতে থাকে। যদিও পরবর্তীতে সেখানে শিবিরের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা প্রমানে ব্যার্থ হয়েছে প্রশাসন।

মোদ্দাকথা, শিবিরকে ঊনমানুষ প্রমান করতে পারলেই মূলত সকল স্বৈরশাসকের জন্য লাভ। কারন, শিবির বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আপোষহীন ছাত্ররাজনীতির নাম। ভবিষ্যতে যাতে শিবিরকে কেউ আর জন্তুরুপে উপস্থাপন করতে না পারে এই ব্যাপারে শিবিরকে সচেতন থাকতে হবে।

ভিডিওতে দেখুন

নয় দফা দাবির মূল কারিগর কে?